ডেইরি খামার লাভজনক করতে সঠিক
পরিকল্পনা ও পরিচর্যা
ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
ডেইরি খামার করে সফল হয়েছে এমন খামারি অসংখ্য। আবার সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনেককেই খামার গুটিয়ে নিতে দেখা গিয়েছে। খামারকে লাভজনক করার জন্য খামার স্থাপনের জন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যত সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা হবে খামার ততটা সফল হবে। খামার স্থাপনের জন্য অবশ্যই স্থান নির্বাচন করা, মার্কেটের অবস্থা, খাদ্যমূল্য ও চারণভূমি ইত্যাদি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। ডেইরি খামারের দুধ বিক্রি কিভাবে হবে এবং ক্রেতা কারা, দাম কেমন ইত্যাদি সম্ভাব্যতা আগেই দেখতে হবে। আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে জাতের ভিন্নতার সুফল পাওয়া যায়। একটি সফল খামার স্থাপনের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
স্থান ও জাত নির্বাচন : স্থান নির্বাচনের জন্য বাজারের অবস্থান, রাস্তা এবং ঘাসের প্রাপ্ততা ইত্যাদি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। বর্তমানে শহরে খামার করার পরিবেশ থাকলে খামার লাভজনক হয়। কারণ শহরে দুধের দাম বেশি অথচ গ্রামে খাবারের দাম শহরের দামের একই পরিমাণ। যেসকল খামারি শহর এলাকায় ডেইরি খামার করেছেন তারা বেশির ভাগ খামারি সফল হয়েছেন। শহরের বাজারে দুধ বিক্রির চ্যানেল ইতোমধ্যে তৈরি করা থাকে, ফলে খুব সহজেই দুধ ভাল দামে বিক্রি করা যায়। জাত নির্বাচন ডেইরি খামারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-
হলিস্টিন ফ্র্রিজিয়ান গরুর বৈশিষ্ট্য : বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের বেশি দুধ দেয় হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী। কালো- সাদা রঙের সুন্দর গঠন, মাথা ছোট, ঘাড় লম্বা, শরীরের পেছনের অংশ যথেষ্ট ভারী আর সামনের দিক সরু লম্বাটে হবে। গরু হবে অনেক উচা লম্বা, জিভ সাদা, চোখ উজ্জ্বল। গরুর ওলানের আকার বড় এবং নরম ঢিলেঢালা হবে। আমাদের দেশীয় আবহাওয়ায় সঠিক খামার ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে বর্তমানে ৪০-৫০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয় এই জাতটি।
শাহীওয়াল গরুর বৈশিষ্ট্য : ধীর ও শান্ত প্রকৃতির, মোটাসোটা ভারী দেহ, ত্বক পাতলা ও শিথি। পা ছোট, শিং ছোট ও পুর, এজাতের গাভীর শিং নড়ে, মাথা চওড়া। গাভীর ওলান বড়, চওড়া, নরম ও মেদহীন, বাঁটগুলো লম্বা, মোটা ও সমান আকৃতি বিশিষ্ট। ষাঁড়ের দৈহিক ওজন ৫০০ -৫২০ কেজি এবং গাভীর ২৫০ - ৪০০ কেজি পর্যন্ত হয়। শাহীওয়াল গাভী দুধ উৎপাদনের জন্য একটি উৎকৃষ্ট জাত। এ জাতের গাভী গ্রামীণ অবস্থায় পালনে ৩০০ দিনে প্রায় ২১৫০ লিটার দুধ দেয়।
জার্সি জাতের গরু চেনার উপায় : লম্বা দেহ, ভারী নিতম্ব ও খাটো পা চূঁড়া হতে কোমড় পর্যন্ত পিঠ একদম সোজা থাকে, মুখবন্ধনী কালো ও চকচকে হয়, মাথা ও ঘাড় বেশ মানানসই, শরীর মেদহীন। গায়ের রং লাল বা মেহগিনি রং বিশিষ্ট। বিশেষ করে মুখের দিকে একটি ঢালাও রঙের উপর সাদা সাদা দাগ যুক্ত থাকে। সাদা দাগগুলো খুব কমও হতে পারে আবার খুব বেশিও হতে পারে। জিহ্বা ও লেজ কালো। শিং পাতলা এবং সামনের দিকে সামান্য বাঁকানো থাকে। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক জার্সি জাতের গাভীর ওজন ৪০০ কেজি থেকে ৫০০ কেজি হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক ষাঁড় ৫৪০ থেকে ৮২০ কেজি হয়ে থাকে। জন্মের পর বাছুরের ওজন প্রায় ২৫ থেকে ২৭ কেজি পর্যন্ত হয়।
গাভীর দুধের উৎপাদন যেভাবে বাড়ানো যায় : গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমান জাতের ওপর নির্ভর করে। গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ দুধের উপাদান যেমন- মাখন, আমিষ, খনিজ পদার্থ সবই বিভিন্ন জাতের গাভীতে কম বেশি হতে পারে। বংশগত ক্ষমতার কারণে দেশীয় জাতের গাভীর দুধের মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে কিন্তু এরা দুধ উৎপাদন করে কম। খাদ্য গাভীর দুধ উৎপাদন ও দুধের গুণগতমানের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। অধিক পরিমাণ খাদ্য খাওয়ালে বেশি দুধ পাওয়া যায়। তবে খাদ্য অবশ্যই সুষম হতে হবে। গাভীকে সুষম খাদ্য না খাওয়ালে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং দধের গুণগতমানও কমতে বাধ্য। কারণ খাদ্যে বিদ্যমান উপাদানগুলো ভিন্ন অবস্থায় দুধের মাধ্যমে নিঃসৃত হয়। খাদ্যে দুধের মাখনের উপস্থিতির পরিমাণ কম বেশি করতে পারে। যে ধরনের খাদ্য খাওয়ালে গাভীর দুধের মাখনের হার কম হতে পারে তাহলো- মাত্রাতিরিক্ত দানাদার খাদ্য; পিলেট জাতীয় খাদ্য; অতিরিক্ত রসালো খাদ্য এবং মিহিভাবে গুঁড়া করা খড়।
গাভীর দুধে মাখনের পরিমাণ কমে গেলে খাদ্য পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে। দুধে খনিজ পদার্থ ও খাদ্যপ্রাণের পরিমাণ গাভীর খাদ্যের মাধ্যমে বাড়ানো যায়। গাভীকে সুষম খাদ্য না দিলে দুধে সামান্য মাত্রায় আমিষ ও শর্করা জাতীয় উপাদান পাওয়া যায় এবং দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। দুধ দোহন বিশেষ করে দোহন কাল, দোহনের সময়, দুধ দোহন প্রক্রিয়া, বিভিন্ন বাঁটের প্রভাব ইত্যাদি গাভীর দুধের পরিমাণ ও মানকে প্রভাবিত করে। গাভীর দুধ দেয়ার পরিমাণ আস্তে আস্তে ৫০ দিনে বেড়ে সর্বোচ্চ হয়। ওলানে দুধের চাপের ওপর দুধের পরিমাণ ও উপাদান নির্ভর করে। দুগ্ধদান কালের ৯০ দিন পর থেকে দুধে মাখন ও আমিষের হার আংশিক বাড়ে। একই গাভীকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দোহন করলে দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। তাই সকালের দুধের চেয়ে বিকেলের দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই গাভীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২-৩ বার দোহন করা উচিত। এতে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তে পারে।
প্রসবকালে গাভীর সুস্বাস্থ্য আশানুরূপ দুধ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাভী থেকে বেশি দুধ পেতে হলে গর্ভকালে সুষ্ঠু পরিচর্যা ও সুষম খাদ্য দেয়া প্রয়োজন। প্রসবের দুই মাস আগে গাভীর দুধ দোহন অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে। মোট দুধ উৎপাদনের ৪০% ওলানের সামনের অংশের বাঁট এবং ৩০% পেছনের অংশের বাঁট থেকে পাওয়া যায়। গাভীর ওলানের বাঁট অবশ্যই সুস্থ থাকতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণ, বাসস্থান, গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমানের হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। পারিপার্শ্বিক অবস্থা গাভীর জন্য আরামদায়ক হওয়া উচিত। দোহনের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করলে অর্থাৎ দুধ দোহন ক্রটিপূর্ণ হলে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমান কমতে পারে।
প্রতিকূল আবহাওয়া দুধ উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর। শীত মৌসুম দুধাল গাভীর জন্য আরামদায়ক। এ মৌসুমে দুধ উৎপাদনের এবং দুধে মাখনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, গরমকাল, বর্ষাকাল, আর্দ্র আবহাওয়ায় গাভীর দুধের উৎপাদন ও গুণগতমান কমে যায়। গাভীর প্রজননের সময় দুধ উৎপাদন কমে যায়। গাভীকে বাচ্চা প্রসবের ৬০-৯০ দিনের মধ্যে বীজ দিতে হবে। কোনোক্রমেই ৬০ দিনের আগে প্রজনন করানো উচিত নয়। গাভীর শরীরে ৫০% এবং দুধে প্রায় ৮৭% পানি থাকে। তাই গাভীকে ইচ্ছামতো পানি পান করার ব্যবস্থা করলে দুধ উৎপাদন বেশি হয় এবং দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে।
গাভীর বড় ওলানের পরিচর্যা : অধিক দুধ উৎপাদনকারী গাভীর দৈহিক আকার যেমন বড় হয় তেমনি বড় হয় তার ওলানও। এসব গাভী যত্নসহকারে পরিচর্যা করতে হয়। উঠা-বসার সময় শেডের কনক্রিটের মেঝেতে ঘষা লেগে ওলানে ক্ষত সৃষ্টি হয়। আর তাতে গোবর বা মূত্র লেগে রোগ-জীবাণুর আক্রমণে গাভী অসুস্থ হয়। ওলানে সমস্যা দেখা দিলে দুধ উৎপাদন কমে যায়। ম্যাসটাইটিস রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করলে কখনও কখনও ওলানের এক বা একাধিক বাঁট কেটে ফেলতে হয়। তখন দুধ উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে।
গাভীর ওলানে আঘাতজনিত সমস্যা এড়াতে কনক্রিটের পরিবর্তে বালুর মেঝে অধিক স্বাস্থ্যসম্মত বলে অভিমত দিয়েছে ডেইরি বিজ্ঞানীরা। এ বালুর মেঝে তৈরি করতে হবে বিশেষ প্রক্রিয়ায়। প্রায় দেড় মিটার সমপরিমাণ গভীর করে মাটি শেডের মেঝে থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এরপর কমপক্ষে দুইস্তরে বড় বড় টায়ার বসাতে হবে। টায়ারের ওপর বিছিয়ে দিতে হবে পরিষ্কার বালু। বালু অবশ্যই কাঁকর, ইটের টুকরা, লোহার টুকরা বা অন্যান্য যে কোনো ধারালো বস্তুমুক্ত হতে হবে। রোগের সংক্রমণমুক্ত এলাকা থেকে এ বালু সংগ্রহ করতে হবে। বালুর মেঝে নরম হওয়ায় গাভী উঠে দাঁড়ানো কিংবা বসার সময় কোনো ধরনের আঘাত পাবে না। ওলানের আঘাতজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা পাবে। এ মেঝের সুবিধাজনক দিক হচ্ছে গাভীর চোনা সহজেই ঝুরঝুরে বালুতে পড়ে শুকিয়ে যাওয়া। তবে বালি যেন ভেজা না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এজন্য দিনে কমপক্ষে দুইবার গোবর পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। সব বালু সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন উলটপালট করে দিতে হবে। ওপরের বালু নিচে এবং নিচের বালু ওপরে উঠে এলে রোগ-জীবাণু বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না, রোগ বাসা বাঁধার সুযোগ পাবে না। ছয় মাস পরপর শেডের পুরনো বালু ফেলে দিয়ে নতুন বালু দিতে হবে।
ডেইরি খামার লাভজনক করার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে হবে। বর্তমানে উন্নত জাত ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে গাভীর দুধ উৎপাদন বেড়েছে। আর খুব বেশি দেরি নেয় যখন আমাদের দেশের দুধের চাহিদা দেশের গাভী থেকে পূরণ করা সম্ভব হবে।
লেখক : ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাণিস¤পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাণিস¤পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭২৩৭৮৬৮৭৭, ই-মেইল : mmrdvm10@gmail.com